সন্তানের সোনালি শৈশবের নতুন সংকট
- গেমিং ডিসঅর্ডার: আসক্তির বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা ও পরিচিতি
- শিশুদের ওপর গেমিং আসক্তির বহুমুখী প্রভাব
- পরিসংখ্যানের আয়নায় বাংলাদেশ ও বিশ্ব
- অভিভাবকদের করণীয়: প্রতিরোধ ও প্রতিকারের কার্যকর উপায়
- সচেতনতার প্রথম ধাপ: লক্ষণগুলো চেনা
- পরিবারকেন্দ্রিক পদক্ষেপ: একটি পারিবারিক চুক্তির প্রস্তাব
- ডিজিটাল সময়ের বাইরে জীবন
- যোগাযোগ ও আদর্শ স্থাপন
- পেশাদার সাহায্য কখন জরুরি?
- ভালোবাসা ও সচেতনতার শক্তি
একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট এবং কম্পিউটারের সহজলভ্যতা আমাদের জীবনকে যেমন গতিশীল করেছে, তেমনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম—শিশুদের জন্য তৈরি করেছে নতুন এক নীরব সংকট। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময় অনলাইন শিক্ষা এবং গৃহবন্দী থাকার কারণে শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় । মোবাইল ও ভিডিও গেমের রঙিন ও দ্রুতগতির জগৎ তাদের কাছে এক নতুন আকর্ষণীয় বিনোদন মাধ্যম হিসেবে ধরা দিয়েছে। কিন্তু যখন এই বিনোদন একটি অভ্যাসে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে আসক্তির রূপ নেয়, তখন এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো আমাদের সামাজিক, পারিবারিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। এই প্রতিবেদনটির লক্ষ্য হলো এই নীরব মহামারির মূল কারণগুলো অনুসন্ধান করা, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলো তুলে ধরা এবং সর্বোপরি, অভিভাবক ও সমাজের কাছে এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারের একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর দিকনির্দেশনা প্রদান করা। এই আলোচনাটি কেবল একটি সমস্যা চিহ্নিতকরণ নয়, বরং আপনার সন্তানের সুস্থ ও স্বাভাবিক শৈশব নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
গেমিং ডিসঅর্ডার: আসক্তির বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা ও পরিচিতি
অতিরিক্ত গেমিংয়ের সমস্যাটি কেবল একটি শখ বা বদভ্যাস নয়। বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসাগত দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি একটি স্বীকৃত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তাদের আন্তর্জাতিক রোগ শ্রেণিবিন্যাসের একাদশতম সংস্করণ (ICD-11)-এ ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’কে একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে । তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, এটি গেমিং আচরণের একটি বিশেষ প্যাটার্ন, যা তিনটি মূল বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়: গেমিংয়ের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব, জীবনের অন্যান্য কার্যকলাপ ও আগ্রহের চেয়ে গেমিংকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া, এবং নেতিবাচক পরিণতি সত্ত্বেও গেমিং চালিয়ে যাওয়া বা এর মাত্রা বৃদ্ধি করা । যখন এই আচরণগুলো কমপক্ষে ১২ মাস ধরে কোনো ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন, পরিবার, সমাজ বা পেশাদার জীবনে গুরুতর প্রভাব ফেলে, তখনই এটিকে ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।
অন্যদিকে, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (APA) তাদের ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডারস (DSM-5-TR)-এ এই অবস্থাকে ‘ইন্টারনেট গেমিং ডিসঅর্ডার’ (IGD) হিসেবে উল্লেখ করেছে । যদিও এটিকে আরও গবেষণার জন্য সুপারিশকৃত শর্তগুলোর তালিকায় রাখা হয়েছে, এর লক্ষণগুলো গেমিং ডিসঅর্ডারের মতোই।

চিকিৎসা পরিভাষায়, অতিরিক্ত গেমে আসক্ত একজন ব্যক্তিকে গেমিং ডিসঅর্ডার বা ইন্টারনেট গেমিং ডিসঅর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ।
বিশেষজ্ঞরা গেমিং আসক্তিকে প্রায়শই “ডিজিটাল ড্রাগ” হিসেবে বর্ণনা করেন । এই নামকরণটি কেবল একটি রূপক নয়, এর পেছনে রয়েছে গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও জৈবিক কারণ। মাদকাসক্তির মতোই, ভিডিও গেম খেলার সময় মস্তিষ্কের ‘রিওয়ার্ড সিস্টেম’ বা পুরস্কার ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। গেমে যখন কোনো লক্ষ্য অর্জন করা হয় বা একটি স্তর অতিক্রম করা হয়, তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক উপাদান নিঃসৃত হয় । এই ডোপামিন আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে এবং খেলোয়াড়কে বারবার এই অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। গেম নির্মাতারা অত্যন্ত সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহার করে গেম ডিজাইন করেন যাতে খেলোয়াড় ক্রমাগত এই ধরনের উদ্দীপনা লাভ করে। এর মধ্যে একটি হলো ‘ভেরিয়েবল রেশিও রেইনফোর্সমেন্ট’ (Variable Ratio Reinforcement) । এই কৌশলে খেলোয়াড় কোনো নির্দিষ্ট পুরস্কার কখন পাবে তা জানে না, ফলে তারা পুরস্কারের আশায় বারবার খেলতে থাকে, যা তাদের মধ্যে তীব্র আসক্তি তৈরি করে।
মাদকের মতো, এই আসক্তিও একজন ব্যক্তির জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। মাদকাসক্ত ব্যক্তি যেমন মাদক না পেলে যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারে , তেমনি গেমিংয়ে আসক্ত ব্যক্তিও গেম থেকে বঞ্চিত হলে প্রচণ্ড রাগ, খিটখিটে মেজাজ বা হতাশায় ভুগতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনা থেকে দেখা গেছে যে, অতিরিক্ত গেমিংয়ের কারণে আত্মহত্যার মতো চরম ঘটনাও ঘটেছে, যা এই আসক্তিকে মাদকের চেয়েও মারাত্মক প্রমাণ করে । গেমিং আসক্তি শুধু একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং এটি একটি গভীর সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট যা পরিবার এবং সমাজকে ভেঙে দেয় ।
শিশুদের ওপর গেমিং আসক্তির বহুমুখী প্রভাব
অতিরিক্ত গেমিং শিশুদের শুধুমাত্র বিনোদন থেকে দূরে সরিয়ে নেয় না, বরং তাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং শিক্ষাগত বিকাশেও গভীর ক্ষত তৈরি করে। এই প্রভাবগুলো একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যা একটি শিশুর সামগ্রিক সুস্থতাকে ব্যাহত করে।
মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি
অতিরিক্ত গেমিং শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গেমে মগ্ন থাকার কারণে শিশুরা বাস্তব জগতের সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যা তাদের মধ্যে একাকীত্ব এবং বিষণ্ণতার অনুভূতি তৈরি করে । গেমিং আসক্তি বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, এবং মন খারাপের মতো অনেক অন্তর্নিহিত মানসিক সমস্যার উপসর্গ হিসেবেও কাজ করতে পারে । কিছু শিশু জীবনের চাপ এবং উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতে গেমিংকে এক ধরনের ‘কোপিং মেকানিজম’ হিসেবে ব্যবহার করে, যা তাদের আসল সমস্যা সমাধানের পথ থেকে আরও দূরে ঠেলে দেয় ।
গেমিংয়ের ফলে শিশুদের মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা তাদের খিটখিটে মেজাজ, রাগ এবং আক্রমণাত্মক আচরণের দিকে পরিচালিত করে । যখন তাদের গেম খেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন তারা বিষণ্ণ, উদ্বিগ্ন বা বিরক্ত হয়ে ওঠে, যা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সুস্পষ্ট লক্ষণ । দীর্ঘক্ষণ গেমিং করার কারণে মনোযোগ এবং একাগ্রতাও ব্যাপকভাবে কমে যায়, যা তাদের পড়াশোনার উপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ।
শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি
অতিরিক্ত গেমিংয়ের কারণে শিশুরা দীর্ঘ সময় ধরে একটি স্থানে বসে থাকে, যার ফলে তাদের শারীরিক সুস্থতা ব্যাহত হয়। এই অলস জীবনযাত্রা তাদের মধ্যে স্থূলতা, হাড় ও পেশী গঠনে বাধা এবং রক্ত সঞ্চালনে জটিলতার মতো শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে । একটানা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে তাদের চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা ‘ডিজিটাল আই স্ট্রেইন’ তৈরি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে দৃষ্টিশক্তি দুর্বল করে তোলে। ক্রমাগত কাছের বস্তুর উপর মনোযোগ দেওয়ার কারণে একসময় তাদের দূরের জিনিস দেখতে অসুবিধা হয় । এছাড়াও, গেমিং আসক্তির কারণে ঘুমের রুটিন অনিয়মিত হয়ে পড়ে এবং খাদ্যাভ্যাস এলোমেলো হয়ে যায়, যার ফলে মাথাব্যথা, হাত ও পিঠে ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, এবং ডায়াবেটিসের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দিতে পারে ।

সামাজিক ও শিক্ষাগত প্রভাব
গেমিং আসক্তি শিশুদের সামাজিক জীবনকে সীমিত করে দেয় এবং তাদের শিক্ষাজীবনে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। অতিরিক্ত গেম খেলার ফলে শিশুরা বাস্তব জীবনের বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । তাদের সামাজিক যোগাযোগ শুধুমাত্র অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, যার ফলে তারা বাস্তব জীবনের মিথস্ক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক দক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় ।
ভিডিও গেমের দ্রুতগতির দৃশ্য এবং তীব্র উদ্দীপনা শিশুদের বিকাশমান মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের কর্মকাঠামোতে পরিবর্তন আনে । এই উচ্চ-গতির ডিজিটাল জগতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তারা বাস্তব জীবনের স্বাভাবিক গতিতে তাল মেলাতে পারে না। এর ফলে তারা অস্থির ও চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে ওঠে এবং ধৈর্যের অভাব দেখা দেয় । এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনগুলো তাদের শিক্ষাজীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। মস্তিষ্কের নতুন কর্মকাঠামোর কারণে তারা পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে। তারা বইয়ের স্থির অক্ষরগুলো পড়ার সময় মনের অজান্তেই কয়েকটি অক্ষর বা শব্দ বাদ দিয়ে চলে যায়, যা তাদের শিক্ষাজীবনে খারাপ ফলাফল নিয়ে আসে । জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, স্মার্টফোনে আসক্ত শিশুরা তাদের বাবা-মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে কম সময় কাটায়, যা পারিবারিক বন্ধনকে শিথিল করে তোলে ।
পরিসংখ্যানের আয়নায় বাংলাদেশ ও বিশ্ব
গেমিং আসক্তি একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ শিশু ও তরুণকে প্রভাবিত করছে। বিশ্বব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে, গেমারদের মধ্যে ৩% থেকে ১৫% কিশোর-কিশোরী ভিডিও গেমের প্রতি আসক্তিতে ভুগছে । একটি বৈশ্বিক জরিপে দেখা গেছে যে, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ৪.৬% ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্ত, এবং ছেলেদের মধ্যে এই হার বেশি । কোভিড-১৯ মহামারির সময় এই আসক্তি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে, কারণ গৃহবন্দী থাকার কারণে ইন্টারনেট এবং গেমিংয়ের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায় । দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের মতো দেশগুলোতে গেমিং আসক্তি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যার জন্য বিশেষ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রও রয়েছে ।
বাংলাদেশে গেমিং আসক্তি নিয়ে ব্যাপক কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই । তবে কিছু বেসরকারি গবেষণা এবং সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো বেশ উদ্বেগজনক। দেশের প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল গেম খেলে । এর মধ্যে শুধু জনপ্রিয় Free Fire গেমটিই খেলছে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ । একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬৪% শিক্ষার্থী গেমিংয়ের প্রতি মধ্যম মাত্রার আসক্ত, এবং ২.৫% গুরুতর আসক্ত । উদ্বেগজনকভাবে, বাংলাদেশে গেমিং আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে, যা প্রমাণ করে যে সমস্যাটি কতটা মারাত্মক হয়ে উঠেছে ।
সাম্প্রতিক সময়ে, অনলাইন গেমিংয়ের সঙ্গে অনলাইন জুয়ার একটি সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে, যা বিশেষ করে তরুণদের জন্য আরও বড় একটি ঝুঁকি তৈরি করছে । অনেক গেমে ‘লুট বক্স’ বা অন্যান্য জুয়া-সদৃশ মেকানিজম থাকে, যা শিশুদের মধ্যে এক ধরনের জুয়া খেলার মানসিকতা তৈরি করতে পারে । এটি একটি গুরুতর বিষয় যা বাংলাদেশের অনলাইন গেমের প্রেক্ষাপটে আরও উদ্বেগের কারণ।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, যে বাবা-মা প্রতিদিন তিন ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, তাদের সন্তানদেরও আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি । এটি প্রমাণ করে যে, পিতামাতার আচরণ শিশুদের ডিজিটাল ব্যবহারের অভ্যাস গঠনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গেমিং আসক্তির পরিসংখ্যানকে আরও সুস্পষ্টভাবে বোঝার জন্য নিচের সারণিটি উপস্থাপন করা হলো:
প্রেক্ষাপট | পরিসংখ্যান | তথ্যসূত্র |
বৈশ্বিক | ||
কিশোর-কিশোরীদের গেমিং আসক্তির হার | আনুমানিক ৩-১৫% | |
গেমারদের মধ্যে আসক্তির প্রবণতা | আনুমানিক ১০% | |
কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক আসক্তি | ছেলেরা (৬.৮%) > মেয়েরা (১.৩%) | |
বাংলাদেশ | ||
মোট ডিজিটাল গেমার | ২ কোটি ৬০ লাখ | |
উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যম মাত্রার আসক্তি | ৬৪% | |
উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গুরুতর আসক্তি | ২.৫% | |
গেমিংয়ের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা (অনলাইন জরিপ) | আনুমানিক ১৭ জন | |
পিতামাতার ৩+ ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার | সন্তানের আসক্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধি |
অভিভাবকদের করণীয়: প্রতিরোধ ও প্রতিকারের কার্যকর উপায়
শিশুদের গেমিং আসক্তি থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব মূলত অভিভাবকদের। এই সমস্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, যা সহানুভূতি, যোগাযোগ এবং সুনির্দিষ্ট নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হবে।
সচেতনতার প্রথম ধাপ: লক্ষণগুলো চেনা
অভিভাবকদের প্রথম কাজ হলো শিশুর আচরণের পরিবর্তনগুলো মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করা। অতিরিক্ত গেমিংয়ের কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে, যা সহজে শনাক্ত করা যায়। যেমন:
- অতিরিক্ত মগ্নতা: শিশু সব সময় খেলা নিয়ে ভাবছে এবং খেলার সুযোগ না পেলে মন খারাপ করছে ।
- নিয়ন্ত্রণহীনতা: গেমের সময়সীমা মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়া এবং খেলা বন্ধ করতে বলা হলে প্রচণ্ড রেগে যাওয়া, চিৎকার করা বা আক্রমণাত্মক আচরণ করা ।
- আগ্রহের অভাব: আগে যেসব কাজ বা খেলাধুলায় আগ্রহ ছিল, যেমন পড়াশোনা, খেলাধুলা বা বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানো, সেগুলোতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা ।
- মিথ্যা বলা: গেমিংয়ের সময়সীমা নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে মিথ্যা বলা ।
- কোপিং মেকানিজম: খারাপ মেজাজ বা হতাশাবোধ থেকে মুক্তি পেতে গেমিংকে একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করা ।
পরিবারকেন্দ্রিক পদক্ষেপ: একটি পারিবারিক চুক্তির প্রস্তাব
শিশুদের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে, বরং একটি “পারিবারিক চুক্তি” তৈরি করার পরামর্শ দেওয়া হয় । এই চুক্তির মাধ্যমে পুরো পরিবার একসাথে বসে স্ক্রিন ব্যবহারের নিয়ম ও সময়সীমা নির্ধারণ করবে, যা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে। এটি শিশুদের মধ্যে একটি ক্ষমতায়নের অনুভূতি তৈরি করে এবং তাদের মনে হয় না যে শুধু তাদেরকেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে । কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম যা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে:
- সময়সীমা নির্ধারণ: প্রতিদিনের খেলার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করুন এবং সেই সময়সীমার মধ্যে থাকতে সাহায্য করুন ।
- ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ: ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে সকল গ্যাজেট, বিশেষ করে স্মার্টফোন, বেডরুমের বাইরে রাখুন। এটি ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে সাহায্য করে ।
- সাধারণ স্থানে গেমিং: সম্ভব হলে গেম খেলার জন্য একটি সাধারণ কক্ষ ব্যবহার করুন, যাতে পিতামাতা সহজেই তাদের সন্তানের খেলার ধরণ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন ।
- বয়স অনুযায়ী গেম নির্বাচন: শিশুদের জন্য উপযুক্ত বয়সের গেম নির্বাচন করুন । PEGI (Pan European Game Information)-এর মতো সংস্থাগুলোর রেটিং দেখে নিশ্চিত হন যে গেমটি আপনার সন্তানের জন্য উপযুক্ত ।
ডিজিটাল সময়ের বাইরে জীবন
গেমিং আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে শিশুদের জন্য অফলাইন কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা অত্যন্ত জরুরি। একটি শিশুর শৈশবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো খেলাধুলা, গল্প বলা এবং অন্যদের সাথে সময় কাটানো। বাবা-মায়ের উচিত শিশুদের জন্য এই ধরনের কার্যকলাপের সুযোগ তৈরি করা।
- বাইরের খেলাধুলা: শিশুদের মাঠে নিয়ে যান, যেখানে তারা সমবয়সীদের সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্যান্য খেলায় মেতে উঠতে পারে । এটি তাদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি সামাজিক দক্ষতা বিকাশেও সাহায্য করবে ।
- বই পড়ার অভ্যাস: ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। গল্পের বই বা ছড়ার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সৃজনশীলতা এবং কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পায়, যা তাদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখে ।
- পারিবারিক সময়: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পরিবারের সবাই একসাথে থাকুন। এই সময়টা গেম বা মোবাইল ছাড়া কাটানোর চেষ্টা করুন। একসঙ্গে খাবার খাওয়া, গল্প বলা বা কোনো খেলাধুলায় মেতে ওঠা পারিবারিক বন্ধনকে আরও মজবুত করবে ।
যোগাযোগ ও আদর্শ স্থাপন
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অভিভাবকদের নিজেদেরই একটি ভালো উদাহরণ স্থাপন করা। যদি বাবা-মায়েরা নিজেদের স্মার্টফোন বা গেমিংয়ে আসক্ত থাকেন, তবে সন্তানের কাছে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে । তাই, নিজেদের স্ক্রিন টাইম সীমিত করা এবং শিশুদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা অপরিহার্য । তাদের আবেগ ও অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাদের প্রতি আপনার ভালোবাসা ও যত্ন প্রকাশ করুন, এমনকি যখন তারা রাগ বা হতাশা প্রকাশ করে । তাদের বোঝান যে, আপনি তাদের ভালো চান বলেই এই নিয়মগুলো তৈরি করেছেন।

পেশাদার সাহায্য কখন জরুরি?
যদি উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো সত্ত্বেও আপনার সন্তানের গেমিং আসক্তি গুরুতর আকার ধারণ করে, তবে পেশাদার সাহায্য নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনার শিশু গেম বন্ধ করার সময় বা পরে তীব্র রাগ, আগ্রাসন, বা সহিংস আচরণ করে, তবে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারের সাহায্য নেওয়া জরুরি । তারা আসক্তির মূল কারণ চিহ্নিত করতে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা বা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে কার্যকর সমাধান দিতে পারেন।
ভালোবাসা ও সচেতনতার শক্তি
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের একটি অনিবার্য অংশ। একে পুরোপুরি অস্বীকার করা সম্ভব নয়, তবে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদেরই দায়িত্ব। গেমিং আসক্তি একটি জটিল সমস্যা হলেও এটি জয় করা অসম্ভব নয়। অভিভাবকের সচেতনতা, পারিবারিক সমর্থন, খোলাখুলি যোগাযোগ এবং নিজেদের ভালো উদাহরণ স্থাপন—এই চারটি মূল স্তম্ভ একটি শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক শৈশব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মনে রাখতে হবে, একটি শিশুর জীবনের সেরা সময় হলো তার শৈশব, যা খেলার মাঠে, বইয়ের পাতায়, এবং পরিবারের উষ্ণতায় কাটানো উচিত। আপনার একটুখানি সচেতনতা, সময় এবং ভালোবাসা আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনকে উজ্জ্বল করতে পারে। এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে আমাদের কোমলমতি শিশুদের একটি সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।